Header Ads Widget

শিক্ষা যা আমরা প্রাণ প্রিয় নবীজির(হযরত মুহাম্মাদ(সা।)থেকে পায়।

শিক্ষা যা আমরা প্রাণ প্রিয় নবীজির(হযরত মুহাম্মাদ সা.)থেকে পায়।



আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ(সা।)আমাদের জীবনের জন্য এক অশেষ নিয়ামত।তিনি আমাদেরকে সত্যের পথ দেখিয়েছেন,দেখিয়েছেন কীভাবে জীবণ কে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়।

তো বন্থুরা চলো জেনে নেওয়া যাক____আমাদের জীবনে মহানবী (সা।)এর প্রভাব এবং আমরা তাঁর কাছ থেকে কী কী শিক্ষা পেয়ে থাকি।


১.আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা।

আল্লাহর প্রতি কীভাবে আনুগত্য স্বীকার করতে হয় তা আমরা মহানবী(সা.)-এর কাছ থেকে পেয়েছি।তিনি আমাদের কে শিখিয়েছেন কীভাবে তাঁর(মহান আল্লাহর) ইবাদত করতে হয়।তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।জীবনের সকল ক্ষেত্রে কোন কাজ গুলো করলে আল্লাহ মহান খুশি হয় তিনি তা আমাদের শিখিয়েছেন।আল্লাহর আনুগত্যের প্রধান মাধ্যম 'নামাজ' তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন।নামাজের মাধ্যেমেই পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর আনুগত্য লাভ করা যায়।আরো একটি সহজ মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য লাভ করা যায় আর সেটি হচ্ছে রাসূলে করিম(সা.)-এর আনুগত্যের মাধ্যমে।রাসূল(সা.) ও আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার সম্পর্কে কুরআন এবং হাদীসে উল্লেখ্য আছে।নিম্নে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার সম্পর্কে কুরআন এবং হাদীসে উল্লেখ্য তথ্যাদি তুলে ধরা হলোঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً * أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُواْ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُواْ إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُواْ أَن يَكْفُرُواْ بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلاَلاً بَعِيدًا * وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْاْ إِلَى مَا أَنزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنكَ صُدُودًا * فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَآؤُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلاَّ إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا * أُولَـئِكَ الَّذِينَ يَعْلَمُ اللهُ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُل لَّهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلاً بَلِيغًا * وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللهِ وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُواْ أَنفُسَهُمْ جَآؤُوكَ فَاسْتَغْفَرُواْ اللهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُواْ اللهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে। তারা বিরোধীয় বিষয়কে শয়তানের দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো যা তিনি রাসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, তারা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তবে তাতে কি হল! অতঃপর তারা আপনার কাছে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে খেয়ে ফিরে আসবে যে, মঙ্গল ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কেও আল্লাহ তা’আলা অবগত। অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোন কথা বলুন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন। অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবানরূপে পেত।

لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ: الدارقطني – مشكاة المصابيح
অর্থঃ স্রষ্টার নাফরমানি করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। (দারাকুতনী- মিশকাতুল মাসাবীহ)

ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে, রাসূলের আনুগত্য। এটি কোন স্বতন্ত্র ও স্বয়ং সম্পূর্ণ আনুগত্য নয়। বরং আল্লাহর আনুগত্যের এটিই একমাত্র বাস্তব ও কার্যকর পদ্ধতি বা মাধ্যম। রাসূলের আনুগত্য এ জন্য করতে হবে যে, আল্লাহর বিধান ও নির্দেশ আমাদের কাছে পৌঁছার তিনিই একমাত্র বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। আমরা কেবলমাত্র রাসূলের আনুগত্য করার পথেই আল্লাহর আনুগত্য করতে পারি। রাসূলের সনদ ও প্রমাণপত্র ছাড়া আল্লাহর কোন আনুগত্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর রাসূলের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামান্তর। নিম্নোক্ত হাদীসে এই বক্তব্যটিই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছেঃ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمَنْ عَصَى أَمِيرِي فَقَدْ عَصَانِي مسند الامام أحمد
অর্থঃ যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহর আনুগত্য করলো এবং যে ব্যক্তি আমার নাফরমানি করলো সে আসলে আল্লাহর নাফরমানি করলো। যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করলো সে আসলে আমার আনুগত্য করলো এবং যে ব্যক্তি আমীরের নাফরমানি করলো সে আসলে আমার নাফরমানি করলো। (মুসনাদে আহমদ)

আল্লাহ তাআলা  বলেন :

لْ أَطِيعُواْ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّ اللَّهَ لاَيُحِبُّ الْكَافِرِينَ 

বলতোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না’ (সূরা আলে-ইমরান)

অন্য এক আয়াতে এসেছে : يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللَّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَوَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً  হে মুমিনগণতোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারিদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর’ (সূরা নিসা: ৫৯)

এক হাদীসে এসেছে : كُلِّ أُمَّتِيْ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْأَبَىْ  قَالُوْا وَمَنْ يَأْبَىْ  قَالَ  مِنَ أَطَاعَنِيْ دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِيْ فَقَدْ أَبَىْ   আবু হুরাইরা রাযি. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যেআমার প্রতিটি উম্মত জান্নাতে যাবে। তবে যে অস্বীকার করে সে নয়। সাহাবায়ে কেরাম বললেন,অস্বীকারকারী কেনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনযে আমার অনুকরণ করল সে জান্নাতে যাবে। আর যে আমার নাফরমানী করলসে-ই অস্বীকারকারী’ (বুখারী)
⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨⇨

২.ধৈর্য্য ধারণ(সহ্য)করার শিক্ষা

শত্রু ও বিরোধীদের মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় ও কার্যকর হাতিয়ার হলো ধৈর্য। মহান আল্লাহ এরশাদ করেনঃ "তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকি হও তবে তাদেঃ(শত্রুর)ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না।" (৩:১২০)।
মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবন বৃত্তান্ত পর্যালোচনা করলে আমি,তুমি,আমরা সকলেই দেখতে পায়,বিভিন্ন বিপদ ও দু:খের সময় তার ধৈর্য ধারণ ক্ষমতাকে।তিনি আমাদের বিপদ ও দু:খের মাঝে ধৈর্য ধারণ(সহ্য)করার শিক্ষা দিয়েছেন।
তিনি শিখিয়েছেন একমাত্র ধৈর্য ধারণ(সহ্য)করার মাধ্যমে জীবনের সকল বিপদ ও দু:খকে দূরীকরণ করা যায়।মহান নবী (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমরা তার ধৈর্যশীলতার পরিচয় পেয়ে থাকি।

এখন চলো!বন্ধুরা,আমরা এমন কিছু ঘটনা পড়ে নিই,যেখানে নবী (সা)-এর ধৈর্যশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়___

নবীয়ত প্রাপ্তির প্রথম তিন বছর মহা নবী(সা) গোপনে তাঁর আত্বীয়স্বজনকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন।পরে আল্লাহর নির্দেশে প্রকাশ্যে ইসলামের পথে দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন।এতে মূর্তি পূজারিরা তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করল।নবিকে তারা ধর্মদ্রোহী,পাগল বলে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগল।তারা তাঁর উপর শারীরিক,মানসিক নির্যাতন চালাল,পাথর ছুড়ে আঘাত করল,আবর্জনা নিক্ষেপ করল,অপমানিত ও লাঞ্ছিত করল।মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সা।)-কে নেত্ত্রিত,ধন-সম্পদ ও সুন্দরী নারীর লোভ ও লিপ্সা দেখাল।সত্য প্রচারে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.)যে আত্মত্যাগ,ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরও সত্য ও ন্যায়ের পথে আত্মত্যাগী,দৃঢ়সংযমী,ধৈর্যশীল ও কষ্ট-সহিষ্ণু হওয়া উচিত।⇀⇀⇀⇀⇀⇀⇀⇀⇀⇀⇀⇀⇀
আরো একটি ঘটনা হচ্ছে এইরূপঃ
বন্ধুরা, তোমরা এটা নিশ্চয়ই জানো যে,  ইসলামী আদর্শ প্রচারের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)'র ত্যাগ ও ধৈর্য ছিল নজীরবিহীন এক দৃষ্টান্ত। আর এটাই(ধৈর্য) ছিল ইসলাম প্রচারে তাঁর সাফল্যের অন্যতম রহস্য। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে চারদিক থেকে শত্রুদের অসহনীয় চাপ, জুলুম-নির্যাতন ও কটুকথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু রহমত ও দয়ার নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সত্য প্রচারের ময়দানে সবসময় ছিলেন দৃঢ়চিত্ত ও ধৈর্যশীল।আমরা নবীজীবনের একটি গল্প বলব যেখানে তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠেছে। মদীনায় যায়েদ নামে এক ইহুদি তাঁর নিজের একটা ঘটনা নবীজীকে এভাবে বলল-
'একদিন একাকী ঘরে বসে ছিলাম। তৌরাত পড়ছিলাম। তৌরাতের এক জায়গায় সর্বশেষ পয়গাম্বরের(মহানবী সা.)-এর কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পড়লাম। একটা বৈশিষ্ট্য হলো নম্রতা ও সহিষ্ণুতা। নিজে নিজে ভাবলাম, মন্দ নয়, মুহাম্মাদের এই বৈশিষ্ট্যটা পরীক্ষা করে দেখব এবং কিছুক্ষণ তাঁর কথাবার্তা ও আচার আচরণ লক্ষ্য করব। তৌরাতে পড়েছিলাম যে, রাগের ওপরে তাঁর ধৈর্য বিজয়ী। এই বিষয়টা দেখার জন্যে আমি মদীনার মসজিদের দিকে রওনা হলাম। ঘটনাক্রমে ঠিক সেই সময়েই মরুবাসী আরবদের দেখলাম মুহাম্মাদের কাছে এসে তাদের নওমুসলিম গোত্রের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে বলছে। তারা মুহাম্মাদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতারও আবেদন জানায়। মুহাম্মাদ তাদের কথা শোনার পর হযরত আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এমন কোনো মালামাল কি আছে এদেরকে দেয়ার মতো?' আলী (আ.) বললেন, 'আপাতত কিছুই নাই।'
ঠিক সে সময় আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী বললাম, এই টাকাটা আমি ঋণ হিসেবে আপনাকে দিচ্ছি। তবে এই টাকার বিনিময়ে আমাকে খুরমার একটা অংশ দিতে হবে। মুহাম্মাদ আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং আমার কাছ থেকে একটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিলেন। সেই টাকা দিয়ে মরুবাসী ওই আরবদের প্রয়োজন মেটালেন।
যায়েদ আরো বলল: খুরমা তোলার আর অল্প ক'দিন বাকি ছিল। কিন্তু আমি মুহাম্মাদের ধৈর্য পরীক্ষা করবার জন্যে তাঁর কাছে গেলাম। আমি জানতাম যে, আমার ঋণ পরিশোধ করবার এখনো কিছুদিন বাকি আছে। তারপরও ঝগড়াটে মনোবৃত্তি নিয়ে বললাম, 'হে মুহাম্মাদ! জনগণের সম্পদ দেয়ার ক্ষেত্রে কৃপণতা করছেন কেন?'
আমি একদম বেপরোয়াভাবে অসৌজন্যমূলক ভাষায় কথা বললাম, অথচ উনি এতো শান্ত এবং মার্জিত ছিলেন যে, এরকম ধৈর্য আমি আর কারো মাঝে দেখি নি। মুহাম্মাদ খালি শুনলেনই আর আমি কেবল অসৌজন্যমূলক আচরণই করে যাচ্ছিলাম। এমন সময় মুহাম্মাদের সঙ্গীদের একজন রেগেমেগে আমার কাছে আমাকে গালি দিল। মুহাম্মাদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন- 'শান্ত হও! উত্তেজিত হবার প্রয়োজন নেই। বরং যায়েদকে ধৈর্য ধারণ করতে বলা উচিত।'
অবশেষে যখন খুরমা পাকল এবং আমার ঋণ পরিশোধ করার সময় হলো, তখন তিনি আদেশ দিলেন আমার প্রাপ্য খুরমাকে অন্যভাবে প্রস্তুত করতে। যখন খুরমাগুলো গ্রহণ করলাম বুঝতে পারলাম যে, আমার প্রাপ্য যতোটুকু তারচে বেশি খুরমা আমাকে দেয়া হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, এই অতিরিক্ত খুরমাগুলো কীজন্য? বললেন- 'যেহেতু তুমি নবীজীর এক সঙ্গীর উত্তেজিত কণ্ঠের কারণে কষ্ট পেয়েছো, সেজন্যে রাসূলে খোদা আদেশ দিয়েছেন তোমার সন্তুষ্টির জন্যে, তোমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে অতিরিক্ত কিছু খেজুর তোমাকে দিয়ে দিতে।'
যায়েদ বলল: আমি মুহাম্মাদের নজীরবিহীন চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হলাম এবং আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মাদের রেসালাতের সাক্ষ্য দিলাম। অবশেষে মুসলমানদের কাতারে নিজেও অন্তর্ভুক্ত হলাম।
প্রাণ প্রিয় নবী(সা.)-এর ধৈর্যের ঘটনা থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে।যা আমাদের জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তো!চলো বন্ধুরা এখন আমরা ধৈর্যশীলতা সম্পর্কে কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ হাদীস ও কোরআনে বর্ণীত কিছু তথ্য জেনে নেয়___________

মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়ে বলেন, "অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ।" (৪৬:৩৫)।
মহান আল্লাহ আরো বলেছেন, "তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।" (২:৪৫, ১৫৩)।

শত্রু ও বিরোধীদের মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো ধৈর্য। মহান আল্লাহ বলেন, "তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকি হও তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না।" (৩:১২০)।

অন্যদিকে রাসূল (সা.) বলেছেন, "রাগান্বিত হয়ো না। আর যদি রাগান্বিত হও, তা হলে বসে পড় এবং আল্লাহর বান্দাদের ওপর তাঁর ক্ষমতার কথা এবং তাদের প্রতি তাঁর ধৈর্যের কথা চিন্তা কর। আর যখন তোমাকে বলা হয় : আল্লাহকে ভয় করো, তখন তোমার ক্রোধকে দূরে ঠেলে দাও এবং ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় প্রত্যাবর্তন কর।"
তিনি আরো বলেছেন, পুণ্যের দরজা তিনটি: মনের উদারতা, মিষ্ট ভাষা, আর কষ্ট ও উৎপাতে ধৈর্যধারণ করা।

 আর এভাবেই মূলত মহানবী (সা.) আমাদের ধৈর্য ধারণ(সহ্য)করার শিক্ষা দেয়।

আমাদের সকলের উচিৎ তাঁর মতো করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিপদ ও দুঃখ-কে ধৈর্যের সাথে গ্রহণ করে তাঁর মকাবেলা করা।
⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝⇝

৩.জীবন আদর্শের শিক্ষা


জীবনকে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে একজন ব্যক্তির আদর্শবান হওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
একটি ভালো আদর্শ না থাকলে সমাজে,রাষ্ট্রে,সর্বোপরি পৃথিবীতে কোনো সম্মান পাওয়া যায় না।
আমরা যদি লক্ষ্য করে থাকি,তাহলে সহজেই আমরা দেখতে পারি মহানবী(সা.)-কীভাবে তাঁর আদর্শ ধারা এই পৃথিবীর মাঝে অবিস্বরনীয় হয়ে আছেন এবং তাঁর আদর্শ এমনভাবে পরিপূর্ণ যে তিনি ও তাঁর আদর্শ পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
একজন ব্যক্তিকে পৃথিবীর মাঝে প্রতিষ্ঠিত করতে,সমাজে তাঁর ব্যক্তিত্ব তৈরিতে,আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে নবীজি আমাদের বহু শিক্ষা ও জ্ঞান দান করেছেন।তিনি যেমন আমাদের আল্লাহর আনুগত্যের শিক্ষা,ধৈর্য ধারণ(সহ্য)করার শিক্ষা দিয়েছেন ঠিক তেমনি নবী(সা.)-আমাদের জীবন আদর্শের শিক্ষা দিয়েছেন।
কুরআন পাক ও হাদীসে জীবন আদর্শের জন্য অনেক কথা বর্ণনা আছে।নিম্মে এর বিস্তারিত আলোচনা করা হলে___
আদর্শ মানব হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুরভিত,সুভাশিত জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের জন্য অনুসরণীয়,অনুকরণীয় আদর্শ। বিশেষ করে তাঁর স্বভাব চরিত্র, আচার আচরণ, কথাবার্তা, হুকুম আহকাম। এগুলো অনুসরণ করলে শুধু সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যাবে তা নয়। বরং আল্লাহর কাছে সঞ্চিত তার উত্তম প্রতিদানে ধন্য হওয়া যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : “নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের  জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।” (সূরা- আহযাব ২১) 
প্রকৃত পক্ষে তিনিই মানুষকে সঠিক ও সরল পথের সন্ধান দিয়েছেন। তার সার্টিফিকেট স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। যেমন তিনি  বলেন : “আপনি তো অবশ্যই সরল পথ প্রদর্শন করেন”। (সূরা আশ-শূরা- ৫২) 
আবার আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসূল (সা.) এর ইত্তেবা করতে হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন : “হে রাসূল (সা.)! আপনি তাদের বলে দিন তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহকে ভালোবেসে থাক তাহলে আমার অনুসরণ কর, তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন”। (সূরা আলে ইমরান- ৩১) 
তাই প্রকৃত অর্থে রাসূল (সা.) সকলের জন্য আদর্শ মানুষ ও পথ প্রদর্শক।
রাসূল (সা.) আদর্শ মানুষ তা-বুঝার সুবিধার্থে এবং প্রবন্ধ সংপ্তি করার জন্য তার জীবন চরিতকে নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হলো।
১. ব্যক্তিগত জীবনে আদর্শ
২. পারিবারিক জীবনে আদর্শ
৩. সামাজিক জীবনে আদর্শ
৪. অর্থনৈতিক জীবনে আদর্শ
৫. শিক্ষা জীবনে আদর্শ
৬ .বিচার ব্যবস্থায় আদর্শ
৭. জিহাদ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় আদর্শ
৮. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আদর্শ
নিম্নে উপরোক্ত ৮টি আদর্শের বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
১. ব্যক্তিগত জীবনে আদর্শ : রাসূল (সা.) এর দৈহিক সৌন্দর্য ছিল যেমন অতুলনীয় তেমনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল অত্যন্ত নির্মল,নির্ভেজাল,স্বচ্ছ ও পবিত্র। সকল মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর সমাহার উপস্থিত ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে। তাঁর এই গুণের কারণে অসভ্য বর্বর আবর জাতির মনের আদালতে এমনই বিশ্বাসের সৌধ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার ফলে তিনিই প্রথম ‘আল-আমিন’ উপাধি লাভ করেন। অথচ তখনও তিনি নবী হননি। অতি সাধারণ মানুষ হিসেবেই সকল মানুষের হৃদয়ের মণি কোঠায় বিশুদ্ধতা ও আস্থার পূর্ণস্থান দখল করে নিয়েছেন। চরম শক্রও তাঁর কাছে তাদের মূল্যবান সম্পদ আমানত রাখত সংকোচহীনভাবে। তিনি সেগুলো হেফাজত করতেন পূর্ণ আস্থার সাথে। এ কথা সত্য যে, তিনি যদি নবী নাও হতেন তাহলেও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও আদর্শ মানুষ হতেন তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এত মানবতা পরায়ণ, কষ্ট সহিষ্ণু, ধৈর্যশীল ছিলেন যে সর্বদা অন্যের কল্যাণে নিজের কষ্ট স্বীকার করতেন। যাদের কল্যাণে তিনি কষ্ট স্বীকার করতেন তারাই তাকে গালাগাল করত, রাস্তায় কাঁটা দিত, তার উপর পাথর মেরে খুন তথা রক্ত ঝরাত, তাঁকে গৃহহারা ও দেশত্যাগে বাধ্য করত। তারপরেও তিনি তাদের জন্য বদ দোয়া করতেন না এবং তাদের কল্যাণ কামনা থেকে বিরত থাকতেন না। ব্যক্তিগত জীবণে অত্যন্ত সৎ স্বভাবের ছিলেন। যা মানুষের জন্য খুবই অনুসরণীয় আদর্শ। যেমন তিনি বলেন, ‘দশটি কাজ স্বভাব ধর্মের অন্তর্গতঃ গোঁফ ছাঁটা, দাড়ি লম্বা করা, মিস্ওয়াক করা, নাকে পানি দেয়া, নখ কাটা, আঙ্গুলের গ্রন্থি ধৌত করা, বগলের লোম উপড়ে ফেলা, নাভির নিচের লোম মুণ্ডন করা এবং পানি কম খরচ করা। তিনি মানুষকে এমন অতি সূক্ষ্ম আদর্শ শিক্ষা দিয়ে গেছেন যা পৃথিবীতে অন্য কেউ দিতে পারেন নাই।
২. পারিবারিক জীবনে আদর্শ : আমরা জানি পরিবার রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক। আর আদর্শ পরিবার সুন্দর-সমৃদ্ধশালী,উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। এই পারিবারিক জীবনে রাসূল (সা.) অনুপম আদর্শের প্রতীক। পারিবারিক জীবনে তিনি পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি, বৃদ্ধ, ছোট-বড় সকলের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। এমনকি পিতা-মাতার অবর্তমানে তাদের বন্ধু-বান্ধবদের অধিকারও নিশ্চিত করেছেন এবং পারিবারিক কাজে স্ত্রীদের সহযোগিতা করেছেন। এমনকি চাঁদনী রাতে মা আয়েশা (রা.) সাথে দৌড় প্রতিযোগিতাও করতেন। তিনি আয়েশা (রা.)কে বলেন তোমরা দিনের আলোতে এবং রাতের আঁধারে আমার মধ্যে যা দেখ তা মানুষের নিকট প্রকাশ কর। মা আয়েশা (রা.) কে রাসূল (সা.) এর জীবন চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে জবাবে বলেন : আল-কুরআন হলো তাঁর জীবন চরিত্র। পারিবারিক জীবনে তিনি যে আদর্শ স্থাপন করেছেন তা সকলের জন্য অনুসরণীয়,অনুকরণীয়।
৩. সামাজিক জীবনে আদর্শ : পৃথিবীর আদি মানুষ হযরত আদম (আ.) হতে সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর প্রাথমিক যুগ থেকে মানবসমাজের ক্রমবৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী সমাজ ব্যবস্থার প্রসার ঘটে। নানা ধরনের জাগতিক বা পার্থিব মোহ ও শয়তানের কু-মন্ত্রণায়, গোত্র, সম্প্রদায় ভেদে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে এবং পরস্পর শত্রুতা করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: মানবজাতি একই সমাজভুক্ত ছিল, অতঃপর তাঁরা বিভেদ সৃষ্টি করল। (সূরা-  ইউনুস : ১৯) 
আর রাসূল (সা.) এর আগমনের প্রাক্কালে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল চরম অশৃংখল,বিপর্যয় ও ঝুঁকিপূর্ণ। সামাজিক অনাচার পাপ-পঙ্কিলতা এত চরমে পৌঁছেছিল যে তারা সব সময় মদ,যুদ্ধ,কাটা-কাটি,বাজি ধরা আর নারী নিয়ে ব্যস্ত থাকত। এমনকি তারা পিতার বিবাহিত স্ত্রীকে বিবাহ করতে কুণ্ঠাবোধ করতো না। এমন বিপর্যয় পূর্ণ অবস্থায় ওহীবিহীন জিন্দেগির ৪০টি বছর সামাজিক কল্যাণমূলক বিভিন্ন কার্মসূচির উদ্যোগ নিয়ে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ফলে নৈতিকতার চরম বিপর্যয়ের সে যুগেও উদভ্রান্ত মানুষগুলোর ইস্পাত কঠিন হৃদয়কে জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সামাজিক সকল অনৈক্য ভুলে একই সূত্রে আবদ্ধ হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা-আলা বলেন----
তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওনা। (সূরা আলে ইমরান-১০৩) 
শুধু তাই নয় আল কুরআনে এবং আল হাদিসে মুসলমানদের পরস্পর ভাই ভাই বলে ঘোষণা করেছেন। সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মহা নবী (সা.) বলেছেন:‘সে ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান নয় যার মুখ ও হাত হতে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।
তিনি আরও ঘোষণা করেছেন:‘ যে ব্যক্তির বড়দের সম্মান করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না সে আমার দলভুক্ত নয়’। (সুনানু আবু দাউদ) 
তিনি বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন: প্রত্যেক মুসলমানের ধন সম্পদ, জান ও ইজ্জত কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্র আমানত হিসেবে জানবে।
তিনি আরবের সেই জাহেলি সমাজকে সোনালী সমাজে পরিণত করেছিলেন কাউকে আহ্বান করে, কাউকে সতর্ক করে, আবার কাউকে ভালোবেসে কাছে টেনে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ইনসাফ ও ন্যায়বিচার দারুণভাবে উপেক্ষিত। মানুষের রচিত মনগড়া মতবাদের যাঁতাকলে মানবতা আজ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এ থেকে বাঁচতে হলে রাসূল (সা.) এর অনবদ্য জীবনের এক বিশাল সমুদ্রে আমাদের পাড়ি জমাতে হবে। কারণ একদা এখান থেকেই পৃথিবীর পথহারা, অচেতন, অর্ধচেতন, তৃষ্ণার্ত মানুষগুলো পেয়েছিল পথের দিশা।
৪. অর্থনৈতিক জীবনে আদর্শ : ইসলাম পূর্ব আরববাসীরা অন্যায় ও অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করত। তারা লুণ্ঠন, রাহাজানি, ছিনতাই, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, ঘুষ, জুয়া, প্রতারণা, দুর্নীতি ইত্যাদি হারাম পন্থায় অর্থ উপার্জন করত। সুদ ছিল অর্থনৈতিক শোষণের প্রধান হাতিয়ার। আর রাসূল (সা.) এগুলো সবকিছু হারাম ঘোষণা করে দেন। তিনি সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা বাতিল করে যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করেন। তিনি সম্পদের মালিকানাকে সুরার ঘোষণা দিয়েছেন। সম্পদ যাতে কথাও কুক্ষিগত না হয় সে লক্ষ্যে অর্থলগ্নীকে উৎসাহিত করেছেন। সম্পদ অপচয় ও অপব্যয় করাকে নিষিদ্ধ করেছেন যদিও তা নিজের হয়। তিনি সুদ এবং মজুতদারীকে হারাম ঘোষণা করেছেন, যাতে সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছুলোকের হাতে কুক্ষিগত না হয়। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেছেন: “যাতে সম্পদ তোমাদের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।’ (সূরা আল হাশর : ৭) 
মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘সাদাকা হলো দলিল’। তিনি গ্রাম ও শহরের যাকাত দাতাদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করে; প্রথমে গ্রামের গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। অবশিষ্ট কেন্দ্রীয় বায়তুলমালে জমা করতেন। রাসূল (সা.) এর প্রণীত অর্থনীতির প্রভাবে সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয়েছিল। ফলে খলিফা হযরত ওমর (রা.) খিলাফতের সময় যাকাত দেয়ার জন্য পথে-পথে ঘুরেও যাকাত গ্রহণ করার মত কোনো লোক পাওয়া যেত না। তাই এ কথা বলতেই হয় অর্থনৈতিক মুক্তিতে রাসূল (সা.) এক মাত্র পথপ্রদর্শক।
৫. শিক্ষা জীবনে আদর্শ : শিক্ষা ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) যে পথ দেখিছেন ইতিহাসের পাতায় তা বিরল,অভাবনীয়। বিশেষ করে জ্ঞান- বিজ্ঞানের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।
তিনি দ্বার্থহীন কণ্ঠে বলেছেন জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ’। (বায়হাকী) 
আবার এ জ্ঞানার্জনের জন্য উত্তম প্রতিদানের কথাও বলেছেন। 
তাঁর উপর প্রথম যে ওহী নাযিল হয়েছিল তাও ছিল “পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন“। (সূরা আল আ‘লাক : ১) 
তিনি ছিলেন জ্ঞানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তাই তিনি বলেছেন ‘আলেমগণ নবীদের উত্তরসূরি’। অপর দিকে পবিত্র কুরআন মজিদে ইলম তথা জ্ঞান শব্দটি এসেছে ৬২৪ বার। রাসূল (সা.) এমন সব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রগতিকে অব্যাহত ও প্রতিষ্ঠিত রাখার গ্যারান্টি প্রদান করেছে। কারণ এতে সকলের অধিকার রয়েছে, ইহা কারো জন্য নির্দিষ্ট ও সীমিত নয়। এর ব্যাপকতার জন্য রাসূল (সা.) বদর যুদ্ধের বন্দিদের শিক্ষার বিনিময় মুক্ত করে দেন। তাঁর জামানায় রাষ্ট্রীয়ভাবে লেখার কাজে ৫০ জন লেখক নিয়োজিত ছিল। মহানবী (সা.) এর হিজরতের পর মসজিদে নববী কেন্দ্রীক “সুফফা” প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পৃথিবীর ইতিহাসে নজির স্থাপন করেছেন।
৬. বিচার ব্যবস্থায় আদর্শ :  গরমযঃ রং জরমযঃ -এ বিশ্বাসের সমাজে বিচারব্যবস্থা বলতে কোনো কিছুই ছিল না। সে সময় রাসূল (সা.) ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করে আমাদের সুষ্ঠু ন্যায় বিচারের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর বিচারব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল মানুষের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। বাদ-বিসম্বাদকারীদের মধ্যে ন্যায়ভিত্তিক বিচার করা। 
যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন: “মানুষের মাঝে যখন বিচার করবে তখন ইনসাফের সাথে করবে।” (সূরা আন নিসা : ৫৮) 
মদিনা নামক মডেল রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। 
আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আল্লাহ তায়ালার নাযিল করা বিধান মতে তাদের মধ্যে বিচার করুন”। (সূরা আল মায়িদাহ : ৪৮) 
তাঁর বিচারব্যবস্থায় ছিল না কোন দলীয়করণ, আত্মীয়প্রীতি, স্বজনপ্রীতি,ধরিবাজী। তিনি ছিলেন সকল মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। একদা এক মহিলাকে চুরির দায়ে হাত কাটার নির্দেশ দিলে, মহিলার বংশ মর্যাদার কথা উল্লেখ করে কিছু সাহাবী হাত না কাটার সুপারিশ করেন। তখন তিনি বলেন, তোমরা জেনে রাখ আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি আজ চুরি করত তাহলে তার হাতও কেটে ফেলতাম।’ তিনি অন্যান্য ধর্মালম্বীদের প্রতিও ছিলেন ন্যায় বিচারক। তিনি তাঁর রাষ্ট্রের অন্যান্য ধর্মালম্বী নাগরিকদের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতেন। শুধু তাই নয় তাদের দেব-দেবিদের গালি দিতে বা কটাক্ষ করতেও নিষেধ করেছেন।
৭. জিহাদ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় আদর্শ :আল্লাহ রব্বিল আলামিন ইসলামে জিহাদ ফরজ বলে ঘোষণা করেছে। তবে তা আক্রামণাত্মক নয় বরং আত্মরক্ষামূলক। 
আল্লাহ তায়ালা বলেন: “যারা তোমাদের সাথে লড়াই করে  আল্লাহর পথে তাদের সাথে তোমরা লড়াই কর তবে সীমা লঙ্ঘন করো না।” (সূরা বাকারাহ : ১৯০)
মহানবী (সা.) এর ২৪ বছরের নবুয়তী জিন্দেগিতে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করেছেন। সরাসরি ২৭টি যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর এ সকল যুদ্ধ ছিল মানবতার মুক্তির জন্য। তায়েফের ময়দানসহ শত শত ঘটনা তাঁর জীবনে খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনের কঠিন ও চরম মুহূর্ত হলো যুদ্ধক্ষেত্র। অথচ সেখানেও তিনি ছিলেন মানবতার কল্যাণে মগ্ন। হিংসা বিদ্বেষ কোনো কিছুই তাঁকে উত্তেজিত করতে পারেনি। আধিপত্য বিস্তার, রাজ্য দখল তাঁর মূলনীতি ছিল না বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানবতার মুক্তি ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। সেনাবাহিনীর প্রতি তার নির্দেশ ছিল, যে “কোনো বৃদ্ধ, শিশু ও নারীকে হত্যা করবে না। গণিমতের মাল আত্মসাৎ করবে না।” মক্কা বিজয়ের দিন তিনি নির্দেশ দেন, আহত ব্যক্তির উপর হামলা চালাবে না। পলায়নরত ব্যক্তির পিছু ছুটবে না, যে ব্যক্তি দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকবে তাকে কিছু বলবে না।
তিনি আরও বলেন সন্ন্যাসীদের কষ্ট দিবে না এবং তাদের উপাসনালয় ভাঙবে না, ফলের বাগান, গাছ ও ফসল নষ্ট করবে না। বদর যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত সবকটি যুদ্ধে তাঁর মোকাবিলায় ১৫ হাজারের বেশি লোক আসে নাই। তারমধ্যেই ৭৫৯ জনের বেশি হতাহতও হয়নি। আরবের ন্যায় মরুভূমির বুকে মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে চরম উচ্ছৃঙ্খল, হিংসুটে, দাঙ্গাবাজ, মানুষ খেকো গোত্র ও ব্যক্তিবর্গকে একটি নৈতিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত করা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। তাই আলেকজান্ডার পাওয়েল বলেন: ‘কিন্তু যুদ্ধ বিজয়ের পর মুসলমানগণ যে পরিমাণে সহনশীলতা প্রদর্শন করেছিলেন তা খ্রিস্টান জাতিসমূহকে লজ্জিত করে।’ সুতারাং শান্তি প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন অতুলনীয়।
৮. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আদর্শ : মহানবী (সা.) এর আন্তর্জাতিক নীতির মূল কথা ছিল বিশ্ব ইসলামী  ভ্রাতৃত্ব। এ ভ্রাতৃত্বই সারা বিশ্বের মানুষকে একই সুতায় গ্রোথিত,একত্রিত করতে সক্ষম করেছে। ভাষা, বর্ণ, পেশাগত ও ভৌগোলিক দিক দিয়ে যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠে তা মানুষকে শান্তি দিতে ব্যর্থ। সকল মানুষই এক সম্প্রদায় ভূক্ত। আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে সকল মানুষের সৃষ্টি। সুতরাং বংশ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, সম্প্রদায় ইত্যাদির ভিত্তিতে মানুষে-মানুষে পার্থক্য করা অযৌক্তিক। কেননা একমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয়। ঐক্যের এ মূলনীতির ভিত্তিতে মহানবী (সা.) পারস্পরিক সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শধ্য বিভক্ত আরব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি বলেছেন: ‘হে লোক সকল! আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : হে মানব জাতি, আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন সমাজ ও গোত্রে বিভক্ত করে দিয়েছি। যেন তোমরা পৃথকভাবে পরিচিতি লাভ করতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় যে তাকওয়ার দিক থেকে অধিক।” সুতরাং অনারবের উপর আরবের, কালোর উপর সাদার কোনো প্রাধান্য নেই। তিনি আরও বলেছেন: ‘সমগ্র মানবজাতি এক আদমের সন্তান, আর আদমের প্রকৃত পরিচয় তাঁকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন থেকে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সকল দাবি, রক্ত ও ধন-সম্পদের সকল দাবি এবং সকল প্রতিশোধ স্পৃহা আমার পায়ের নিচে পদদলিত হলো। এ হলো তাঁর আন্তর্জাতিক নীতি। এ নীতিই পারে আন্তর্জাতিক বিশ্বে শান্তি আনয়ন করতে।

আমরা এ কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, মানব রচিত মতবাদের ব্যর্থতা সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে যার ব্যপকতা বিরল। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো মহা নবী (সা.) মানুষের যে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছেন তা নিশ্চিত করা। তাঁর অনুসারীরা তাঁর এ আদর্শকে  ১০০ ভাগ বাস্তবায়ন করে একটি সোনালী সমাজের ভিত রচিত করেছেন। বহু শতাব্দী অতীত হয়ে যাওয়ার পরেও আজকের সমাজ ও সভ্যতা যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা  হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অবদান। তাই আজকে আমাদের সকলের প্রয়োজন তাঁকে আমাদের আদর্শ হিসেবে পরিপূর্ণভাবে মেনে নেয়া।

৪.মানবতার শিক্ষা

মানুষের মনে মানবতা না থাকলে সে কখনোই কারো কাছে প্রকৃত সম্মান পায় না।মানবতা ধারা সকলের কাছে আপন হওয়া যায়।যার মাঝে কোনো মানবতা নেয়,সে কাউকে ভালোবাসতে জানে না,কাউকে উপকার করতে জানে না,সর্বোপরি সে মানুষের উপকারে আসে না।তাই মানুষের জীবনে মানবতার শিক্ষা খুবই গুরুত্তপূর্ণ বিষয়।

মহান নবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.)-এর জীবন থেকে আমরা মানবতার শিক্ষা পেয়ে থাকি।মহান নবী(সা.)মানবতার এর প্রতীক।তাঁর মানবতার শিক্ষা তিনি ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না।

জাহেলিয়াতের চরম অন্ধকার যখন পৃথিবীকে গ্রাস করে বসেছিল, সেই চরম দুর্দিনে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বশান্তির বার্তা নিয়ে দুনিয়ায় এলেন। তখন মানুষ হয়ে পড়েছিল সৃষ্টির দাসত্বে বন্দি। নারী জাতি ও দাস-দাসীরা ছিল চরমভাবে নিপীড়িত। কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়ার মতো জঘন্য অপরাধ করতেও হূদয়হীন মা-বাবা কুণ্ঠিত হতো না। মানবতা ও মনুষ্যত্ব বলতে কিছুই তখন অবশিষ্ট ছিল না। অনিয়ম, হানাহানি, সন্ত্রাস, কুসংস্কার ও শোষণ-নিপীড়নে গোটা মানবসভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। মহানবী (সা.) হেদায়াত ও সংস্কারের এক আলোকবর্তিকা নিয়ে মানবতার কাছে উপস্থিত হলেন। হেরার যে আলোকরশ্মি তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ধারণ করলেন, তার মাধ্যমেই তিনি মহান এক সভ্যতা বিশ্বের মানুষের কাছে উপস্থাপন করলেন। অন্ধকারময় আরবে মানবতা ছিল বন্দি। সমাজে মানবাধিকারের লেশমাত্র ছিল না। এ অবস্থা থেকে মানবতাকে বাঁচাতে মহানবী (সা.) সমাজের সব পর্যায়ে মানবাধিকারের এমন এক নমুনা পেশ করেন, যা আজও জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে গোটা বিশ্বের কাছে অনন্য হিসেবে স্বীকৃত। তিনি শ্রেণি ও বংশগত বৈষম্যের অবসান ঘটান। চাকর-বাকর ও দাসরা এত দিন যে নীচ বলে পরিগণিত হতো, তাদের সঠিক মানবিক মর্যাদা মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি বিশ্বমানবতার মুক্তির প্রতীক ও সত্য-সুন্দরের বাণীবাহক। তাঁর আদর্শ ও চারিত্র্যিক মাধুর্যের কারণে বর্বর আরব জাতি একটি সুমহান জাতিতে পরিণত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশ কৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করেন। বিশ্ব ইতিহাসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-ই সর্বপ্রথম দাসপ্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রাক-ইসলামী যুগে পৃথিবীর কোথাও নারীর সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তারা ছিল অবহেলার পাত্র ও সন্তান উত্পাদনের যন্ত্র। তাদের অপবিত্র মনে করা হতো। পৃথিবীর ইতিহাসে মহানবী (সা.)-ই সর্বপ্রথম নারী জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

হাদীস ও কোরআনে তাঁর মানবতার পরিচয় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।নিম্নে তা তুলে ধরা হলো_↴

কোরআনে আল্লাহ বলেনঃ''নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) সকল যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। কারণ, তাঁর মধ্যে মানবিক পূর্ণতার সকল বৈশিষ্ট্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। মহান আল্লাহ্ তাঁকে স্বীয় অসীম জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে জ্ঞান দান করেছিলেন (সূরা নামল : ৬)''
এবং স্বয়ং তিনিই তাঁকে প্রশিক্ষিত করেছেন (আল কাফি, ১ম খণ্ড, ২৬৬)।
রাসূল (সা.) এর জীবন ছিল ভদ্রতা-সভ্যতা ও শিষ্টাচারের এক অপূর্ব সমাহার।
মহানবী (সা.) বলেছেন, “যারা আমাদের ছোটদের আদর করে না এবং বড়দের সম্মান করে না তাদের সাথে আমার সম্পর্ক নেই।”
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, “কারো সাথে দেখা হলে একটু মিষ্টি করে হাসা উত্তম ছদকা।”

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আব্বা-আম্মাকে খুশি রাখার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সন্তানের প্রতি পিতা খুশি থাকলে আল্লাহও খুশি থাকবেন। পিতা খুশি না থাকলে আল্লাহ খুশি থাকবেন না। মা-বাবার প্রতি সদাচরণ ও ভাল ব্যবহার করার জন্য মহান প্রভু আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। নবী জীবনের একটি ঘটনা থেকে আমরা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি।
রাসূল (সা.) সাহবীদের এক সভায় আলোচনা রাখছিলেন। এমন সময় একজন ভদ্র মহিলা সেখানে আসলেন। রাসূল (সা.) উঠে গিয়ে তাকে সালাম জানালেন এবং নিজের গায়ের গেলাফ মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে তাঁকে বসতে বললেন। সাহবীরা অদূরে বসে দেখছেন। ভাবছেন, কে এই সৌভাগ্যবান নারী যে বিশ্বনবীর (সা.) গায়ের চাদরে বসার স্পর্ধা দেখাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর আগন্তুককে বিদায় দিয়ে নবীজী (সা.) ফিরে এলেন মজলিসে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী কে এই মহিয়সী নারী? বিশ্বনবী (সা.) বললেন, উনি আমার দুধ মা বিবি হালিমা। মায়ের প্রতি ভালোবাসা, নারীর প্রতি সম্ভ্রম প্রদর্শনের এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কি হতে পারে। মিথ্যা না বলা, সত্যাশ্রয়ী হওয়া, ক্ষমা করা, ওয়াদা পালন, আমানতদার হওয়া সবক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল (সা.) এক অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন। একবার এক লোক এসে রাসূল (সা.) কে বললো, “আমি অনেক খারাপ কাজ করি। সব মন্দ কাজ আমার পক্ষে একবারে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। আপনি আমাকে একটি পাপ কাজ ত্যাগ করার নির্দেশ দিন।” মহানবী (সা.) বললেন, “ঠিক আছে তুমি মিথ্যা কথা বলবে না।”
লোকটি বললো, এতো খুব সহজ কাজ। পরে দেখা গেলো, মিথ্যা কথা বলা ছাড়ার কারণে লোকটির পক্ষে- আর কোনো খারাপ কাজ করা সম্ভব হলো না। এই ছোট পরিসরে রাসূল (সা.) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।

রাসূল (সা.) বিদায় হজ্বে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তার অংশ বিশেষ তোমাদের সামান্য তুলে ধরতে চাই। বন্ধুরা! দেখবে সেখানে নবীজি (সা.) মানবতার উৎকর্ষ সাধনে কত মূল্যবান ও ভালো ভালো কথা বলে গেছেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, 
* হে মুসলিম, আঁধার যুগের সমস্ত ধ্যান ধারনাকে ভুলে যাও, নব আলোকে পথ চলতে শিখো। আজ হতে অতীতের সব মিথ্যা সংস্কার, অনাচার ও পাপ প্রথা বাতিল হয়ে গেল। 
* মনে রাখবে- সব মুসলমান ভাই ভাই। কেউ কারো চেয়ে ছোট নয়। কারো চেয়ে বড় নয়। আল্লাহর চোখে সবাই সমান।
* নারী জাতির কথা ভুলে যেও না। নারীর ওপর পুরুষের যেরূপ অধিকার আছে, পুরুষের ওপর নারীরও সেরূপ অধিকার আছে। তাদের ওপর অত্যাচার করো না। মনে রাখবে, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তোমাদের স্ত্রীগণকে গ্রহণ করেছো।
* প্রত্যেক মুসলমানের ধন-প্রাণ পবিত্র বলে জানবে। যেমন পবিত্র আজকের এই দিন, ঠিক তেমনি পবিত্র তোমাদের পরস্পরের জীবন ও ধন সম্পদ।
* দাস-দাসীদের প্রতি সর্বদা সদ্ব্যবহার করবে। তাদের ওপর কোনরূপ অত্যাচার করবে না। তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তাই খাওয়াবে। যা পরবে তাদেরকেও তাই পরাবে। ভুলোনা- ওরাও তোমাদের মত মানুষ।
* সাবধান! পৌত্তলিকতার পাপ যেন তোমাদের স্পর্শ না করে। র্শিক করবে না। চুরি করবে না, মিথ্যা কথা বলবে না। ব্যভিচার করবে না। সর্ব প্রকার মলিনতা হতে নিজেকে মুক্ত করে পবিত্রভাবে জীবনযাপন করবে। চিরদিন সত্যাশ্রয়ী হয়ে থাকবে।
* বংশের গৌরব করবে না। যে ব্যক্তি নিজ বংশকে হেয় মনে করে অপর এক বংশের নামে আত্মপরিচয় দেয়, আল্লাহর অভিশাপ তার ওপর নেমে আসে। (বোখারী-মুসলিম)
তাই বলবো, এসো আমরা রাসূল (সা.) কে জানি। তার আদর্শে জীবন গড়ি। তবেই কেবল আমাদের জীবন থেকে সকল দুঃখ-ক্লেশ জরা কুহেলিকা, কুসংস্কার দূরীভূত হবে। নেমে আসবে শান্তির ফল্গুধারা। এসো দরুদ পড়ি- “ইয়া রাব্বি সাল্লি ওয়া সাল্লিম দায়েমান আবাদান আলা হাবিবিকা খায়রিল খালকী কুল্লিহীম।”
তো!বন্ধুরা দেখলে কীভাবে মহান নবী(সা.)আমাদের খুব সহজেই মানবতার শিক্ষা দিয়ে গেছেন।যার আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।আশা করি আমরা সকলেই মানবতার পরিচয় দিয়ে সমাজের,রাষ্ট্রের ও পুরো পৃথিবীর সকলকে সাহায্য,ভালোবাসা,স্নেহ করি।

৫.জ্ঞান আহোরণের শিক্ষা

আমরা জানি যে,জ্ঞান আহোরণ করা প্রত্যেক মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য ফরজ।জ্ঞান আহোরণ ছাড়া কখনোই শিক্ষার আলো অর্জন করা যায় না।তাই মহানবী(সা.)-জ্ঞান আহোরণ করার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

জ্ঞান আহোরণ আমরা বিভিন্নভাবে করতে পারি।তার মাধ্যম মহানবী(সা.)আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

মহানবী (সা.)-কে তাঁর পূর্বের ও পরের সব প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করা হয়েছে। তাঁকে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোরআন দ্বারা সব জ্ঞান দান করা হয়েছে। এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমার দায়িত্ব তা মুখস্থ করিয়ে দেওয়া আর তা আপনার বক্ষে ধারণ করিয়ে দেওয়া এবং পাঠ করার তাওফিক দেওয়া। তাই যখন আমি (জিবরাইলের সূত্রে) পড়ব, আপনি তাঁর অনুসরণ করুন, অতঃপর আমি আপনাকে বয়ান (ব্যাখ্যা) করে দেব।’ (সুরা কিয়ামা, আয়াত : ১৭)

⇒পবিত্র কুরআনে নামাজ পড়ার ব্যাপারে ৮২ জায়গায় তাগিদ দেয়া হয়েছে, আর জ্ঞান-চর্চার উপর তাগিদ দেয়া হয়েছে ৯২ জায়গায় । নবী করীম (সা.) এর প্রতি মহান রাব্বুল আলামীনের প্রথম আদেশই  হল (ইক্বরা) অর্থাৎ পড় । মহান আল্লাহ তাআলা বলেন :-
 اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَخَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍاقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ الَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِعَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ 
পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি (সকল কিছু) সৃষ্টি করেছেন  তিনি মানুষকে ঘনীভূত রক্ত হতে সৃষ্টি করেছেন   পাঠ কর, আর তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত   যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন  শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (আলাক্ব ১-৫)
কোরআনে ও হাদীসে জ্ঞান চর্চার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। 

কোরআনের আলোকে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব :

পবিত্র কোরআনে জ্ঞান চর্চার ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এ সম্পর্কে  মহান আল্লাহর কিছু বাণী উল্লেখ করা হল : 
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ 
১. ‘পাঠ কর, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ -সূরা আলাক : আয়াত ১। 
وَقُلْ رَّبِّ زِدْنِىْ عِلْمًا 
২. ‘বলো: হে প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।’ -সূরা তোয়াহা : আয়াত ১১৪। 
فَأَسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ 
৩. ‘যদি তোমরা না জানো, তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।’ -সূরা আন নহল : আয়াত ৪৩। 
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ 
৪. ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন। -সূরা  মুজাদালা : আয়াত ১১। 
هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ 
৫. ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা উভয় কি সমান হতে পারে?’ -সূরা জুমার : আয়াত ৯। 
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ 
৬. ‘যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই তার অনুসরণ কর না ।’ -সূরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৬। 
فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ 
৭. ‘আল্লাহকে সেভাবে স্মরণ করো, যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন।’ -সূরা আল বাকারা : আয়াত ২৩৯। 
يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ 
৮. ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিকমত (বিশেষ জ্ঞান ) দান করেন এবং যাকে (আল্লাহর পক্ষ হতে) হিকমত দান করা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তাকে প্রভূত কল্যাণ দেওয়া হয়েছে।  -সূরা বাকারা : আয়াত ২৬৯। 
كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ
9. (হে মুসলমানগণ!) যেমন আমি তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্য হতে একজন রসূল প্রেরণ করেছি, সয তোমাদেরকে আমার আয়াত পড়ে শুনায়, তোমাদের পরিশুদ্ধ করে এবং তোমাদের আল কোরআন ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়; তোমাদের আরো শিক্ষা দেয় যা তোমরা কখনই জানতে না সেগুলো।’ -সূরা আল বাকারা : আয়াত ১৫১। 

হাদিসের আলোকে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব :
জ্ঞানার্জন সম্পর্কে রসূলুল্লাহও (সা.) বিশেষভাবে তাগিদ করেছেন। তিনি বলেছেন : 
১. ‘আল্লাহ যখন তার কোন বান্দার কল্যাণ করতে ইচ্ছা পোষণ, তাকে তিনি ধর্মিয় বিষয়ে পান্ডিত্য দান করেন।’ -আল কফি, ১ম খণ্ড, পৃ-৩২। 
২. ‘সোনা রূপার খনির মতো মানুষও (বিভিন্ন প্রকারের) খনি। তাদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উত্তম (গুণ বৈশিষ্ট্যধারী) হয়ে থাকে, দীনের সঠিক বুঝ-জ্ঞান লাভ করতে পারলে ইসলাম গ্রহণের পরও তারাই উত্তম মানুষ হয়ে থাকে।’ -সহীহ মুসলিম : আবু হুরাইরা রা.। 
৩. ‘জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা জ্ঞানী ও বিজ্ঞানীদের হারানো ধন। সুতরাং যেখানেই তা পাওয়া যাবে, প্রাপকই তার অধিকারী। -তিরমিযি। 
৪.‘ইসলামের একজন সঠিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি শয়তানের জন্যে হাজারো (অজ্ঞ) ইবাদতগুজারের চাইতে ভয়ংকর।’ -তিরমিযি। 
৫. ‘জ্ঞানান্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের একটি অবশ্য কর্তব্য ।’ – আল কফি, ১ম খণ্ড, পৃ-৩৮। 
৬. ‘দীনের জ্ঞানী ব্যক্তি কতইনা উত্তম মানুষ। তার কাছে লোকেরা এলে তিনি তাদের উপকৃত করেন, আর না এলে তিনি কারো মুখাপেক্ষী হন না।’ -রিযযীন, মিশকাত। 
৭. ‘জ্ঞানের আধিক্য (নফল) ইবাদতের আধিক্যের চাইতে উত্তম।” -বায়হাকি : আয়েশা রা.। 
৮. ‘সর্বোত্তম মানুষ হলো তারা, জ্ঞানীদের মধ্যে যারা উত্তম।’ -দারমি। 
৯. ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : জ্ঞানের যাকাত হল অন্যকে জ্ঞান শিক্ষা দেয়া। 
জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন :
১. ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের কোনো পথ অবলম্বন করে, তাতে আল্লাহ তার জন্যে জান্নাতের একটি পথ সহজ করে দেন। যখন কিছু লোক আল্লাহর কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব (কোরআনে) পড়ে এবং নিজেদের মাঝে তার মর্ম আলোচনা করে, তখন তাদের উপর নেমে আসে প্রশান্তি, ঢেকে নেয় তাদেরকে আল্লাহর রহমত, পরিবেষ্টিত করে তাদেরকে ফেরেশতাকুল। তাছাড়া আল্লাহ তাঁর কাছের ফেরেশতাদের নিকট তাদের কথা আলোচন করেন। যার আমল (কর্ম) তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশ তাকে এগিয়ে দিতে পারে না।’ -সহীহ মুসলিম। 
২. ‘ফেরেশতারা জ্ঞানান্বেষণকারীদের জন্যে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেয় (অর্থাৎ তাদের সহযোগিতা করে ও উৎসাহিত করে)’। -মুসনাদে আহমদ। 
৩. ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানান্বেষণে আত্মনিয়োগ করে, এ কাজের ফলে তার অতীতের দোষত্রুটি মুছে যায়।’ -তিরমিযি, দারমি। 
৪. ‘তোমাদের মাঝে সবচেয়ে ভালো মানুষ সে, যে নিজে কোরআনে শিখে এবং অন্যদের শিখায়।’ -বুখারি : উসমান রা.। 
৫. ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানান্বেষণ করে তা অর্জন করেছে, তার জন্যে দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। আর যদি তা লাভ করতে নাও পেরে থাকে তবু তার জন্যে একগুণ প্রতিদান রয়েছে।’ -দারমি। 
৬. ‘রাতের কিছু অংশ জ্ঞান চর্চা করা, সারা রাত (ইবাদতে) জাগ্রত থাকার চাইতে উত্তম।’ -দারমি। 
৭. ‘জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা, এমনকি পানির নিচের মাছ। অজ্ঞ ইবাদতগুজারের তুলনায় জ্ঞানী ব্যক্তি ঠিক সেরকম মর্যাদাবান, যেমন পূর্ণিমা রাতের চাঁদ পৃথিবীবাসীর কাছে তারকারাজির উপর দীপ্তিমান। আর জ্ঞানীরা নবীদের ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী।’ -আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ। 

জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ও হাদিসের বক্তব্যের পর এ পর্যায়ে এ সম্পর্কেই কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা বলব।
 
১.“একবার এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে উপস্থিত হয়ে জানতে চাইল, হে আল্লাহর রাসূল! যদি কোনো ব্যক্তির জানাযার একই সময়ে কোনো ইলমী জলসা অর্থাৎ জ্ঞানার্জনের বৈঠক থাকে তাহলে আমি কোনটিতে অংশ নিতে পারি? রাসূলেখোদা বললেন, জানাযায় অংশগ্রহণ ও দাফন-কাফন করার জন্যে অন্য লোক থাকলে তুমি ইলমী জলসায় উপস্থিত হও। নিশ্চয়ই জ্ঞান চর্চার অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া হাজারটা জানাযায় অংশগ্রহণ থেকে, হাজারটা অসুস্থ লোকের খোঁজ নেয়া থেকে, হাজার রাত ইবাদত করা থেকে, হাজার দিন রোযা পালন থেকে, হাজার দেরহাম সদকা দেয়া থেকে, হাজার বার নফল হজ্জ করা থেকে এবং হাজারটা নফল জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে উত্তম। এরপর রাসূল (সা.) বললেন, “ইলম দ্বারাই আল্লাহর আনুগত্য হয়, ইলমের দ্বারাই আল্লাহর ইবাদত সম্পন্ন হয়। জ্ঞানের মধ্যে দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গল নিহিত যেমনিভাবে মুর্খতার সাথে দুনিয়া ও পরকালের অনিষ্টতা নিহিত রয়েছে।”
 
২. একবার রাসূলেখোদা মসজিদে নববীতে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন দু’দল লোক গোল হয়ে বসে কোনো কাজে ব্যস্ত আছে। একদল আল্লাহর যিকির-আযকার ও ইবাদত-বন্দেগী করছে আরেকদল জ্ঞানচর্চার কাজে মশগুল। রাসূলুল্লাহ (সা.) দু’দলকে দেখেই খুশী হলেন এবং তাঁর সাথের লোকদেরকে বললেন, “এ দু’দল লোকই ভালো কাজে ব্যস্ত আছে এবং এরা সবাই উত্তম ও পূণ্যবান। কিন্তু আমাকে পাঠানো হয়েছে লোকজনকে শিক্ষা দিয়ে জ্ঞানী করে গড়ে তোলার জন্য।”
এ কথা বলেই তিনি সেই দলের দিকে এগিয়ে গেলেন যারা শিক্ষা দান ও গ্রহণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনিও তাদের সঙ্গে বসলেন এবং শিক্ষাদানের কাজে লেগে গেলেন।
রাসূলে খোদা (সা.) মুর্খতাকে অপছন্দ করতেন বলেই আজীবন তিনি জ্ঞান বিতরণ করেছেন এবং সবখানে শিক্ষার আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেছেন।
৩.  দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমজান শুক্রবার অনুষ্ঠিত বদরের যুদ্ধে । ৭০ জন কাফেরকে বন্দী করে মদীনায় আনা হয়। এই বন্দীদের মুক্তিপণ হিসাবে অর্থ বা অন্য কোন সম্পদ নির্ধারণ না করে  আমাদের প্রিয় নবী ঘোষণা দেন যে, বন্দীদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তারা প্রত্যেকে ১০জন করে নিরক্ষরকে শিক্ষা দান করতে পারলে বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাবে। 
জ্ঞানই সবকিছুর ভিত্তিমূল । জ্ঞানের আলোকেই মানুষ ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। জ্ঞান তথা শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় জাতিসত্তা। কোন জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হ’ল শিক্ষা। জাতীয় আশা-আকাঙ্খা পূরণ, জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে চরিত্র গঠন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও বিভাগে নেতৃত্বদানের উপযোগী ব্যক্তিত্ব তৈরি করা কেবলমাত্র উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রধান উপকরণও শিক্ষা ।
কোন জাতিকে একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হ’লে সেই জাতির লোকদেরকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে । যখন তারা সেই আদর্শ অনুযায়ী তৈরি হবে তখনই একটি সফল সামাজিক বিপ্লব সাধন সম্ভব। সকলকে এই সত্যটি উপলদ্ধি করতে হবে । শিক্ষক মহোদয়, ছাত্র ছাত্রী দিগকে তাহাদের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে অন্যথায় জাতির কোন আশা থাকবেনা ।  দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ জ্ঞান চর্চা ছেড়ে দিয়ে মুর্খতাকে গ্রহণ করে মুসলমানরা কুরআনের নির্দেশ থেকে যেমন দুরে সরে গেছে তেমনি নিজেদের অবস্থানকেও দুর্বল করে ফেলেছে। তাই নিজেদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে হলে সবাইকে জ্ঞান চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে।
 মহানবী (ছাঃ) মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে জাহেলিয়াতের গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জাতিকে একটি বিশ্ববিজয়ী জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হন।

তো বন্ধুরা আমরা সহজেই বলতে পারি,আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত করে গড়ে তুলার জন্য মহানবীর এ সকল শিক্ষা আমাদের জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন।আমাদের সকলেরই উচিৎ তাঁর দেখান শিক্ষা গ্রহন করে আমাদের জীবন প্রতিষ্ঠিত করা।


বন্ধুরা!আরো সুন্দর ও জ্ঞান সম্মত লেখা পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
আমাদের ফেইসবুক পেজ--------রকমারি শিক্ষা
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল--------- রকমারি শিক্ষা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Article End Ads